The Bengal Lens প্রতিবেদন | মে ২০২৫
নারীর অধিকার বিষয়ক বেশ কয়েকটি আইনি সংস্কার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে আজ রাজধানী ঢাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে হেফাজতে ইসলাম। সংগঠনটি দাবি করে, প্রস্তাবিত আইনসমূহ ধর্মীয় বিশ্বাস ও পারিবারিক কাঠামোর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
সমাবেশের পূর্বেই তারা ঘোষণা দিয়েছেন , যদি সংশ্লিষ্ট আইন সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো বাতিল না করা হয়, তবে তারা “সারাদেশ অচল করে দেওয়ার” কর্মসূচি ঘোষণা করতে বাধ্য হবে।
এর আগে, নারী ও শিশু বিষয়ক সংস্কার কমিশন একটি খসড়া প্রস্তাবে বৈষম্য দূরীকরণ ও নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে কিছু আইনগত পরিবর্তনের সুপারিশ করে। এর মধ্যে রয়েছে বিবাহিত ধর্ষণকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা, অভিভাবকত্ব, উত্তরাধিকার এবং কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা সংক্রান্ত আইনি সংশোধন।
এছাড়াও গুঞ্জন রয়েছে এ সমাবেশে উপস্থিত থাকবেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয় , বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির আহ্বায়ক এবং জাতীয় নাগরিক পার্টির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক “হাসানাত আবদুল্লাহ “
এ বিষয়ে এখনো সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি।
প্রস্তাবিত আইনি সংস্কারগুলো কী কী?
এই প্রস্তাবনায় যেসব বিষয় যুক্ত করা হয়েছে, সেগুলো কেবল সমাজতাত্ত্বিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং বাংলাদেশের আইনি ইতিহাসে রীতিমতো যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবেই বিবেচিত হতে পারে।
১. বৈবাহিক ধর্ষণ (Marital Rape) কে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব
বর্তমানে বাংলাদেশে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ধর্ষণকে “ধর্ষণ” হিসেবে গণ্য করা হয় না। এই প্রথাগত বিধান নারীর সম্মতির অধিকারকে অস্বীকার করে। কমিশনের প্রস্তাব বলছে, “বিয়ে মানেই সম্মতির চিরস্থায়ী চুক্তি নয়”—এমন ভুল ব্যাখ্যার জায়গা বন্ধ করে দেওয়া হোক। এ উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশ হবে দক্ষিণ এশিয়ায় বিরল কিছু দেশের একটি, যারা নারীর যৌন অধিকারকে বৈধভাবে সম্মান দেয়।
২. অভিভাবকত্ব আইনে লিঙ্গ-নিরপেক্ষতা
বর্তমান আইন অনুযায়ী, বাবা অধিকাংশ ক্ষেত্রে “প্রধান অভিভাবক” হিসেবে বিবেচিত হন। কমিশনের প্রস্তাবনা হলো, “অভিভাবক” শব্দের মানে হবে পিতা-মাতা উভয়েই সমানভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত, বিশেষ করে যেখানে মা এককভাবে সন্তান পালন করছেন, সেক্ষেত্রে তার অধিকার যেন লঙ্ঘিত না হয়।
৩. উত্তরাধিকার আইন সংস্কার
অত্যন্ত স্পর্শকাতর হলেও বাস্তবতা হলো—নারীরা তাদের ভাইদের তুলনায় অর্ধেক সম্পত্তির ভাগ পান। কমিশনের সুপারিশ হলো, শারীরিক যোগ্যতা নয়, আইনিক অধিকারই হোক সম্পত্তি বণ্টনের মূল ভিত্তি। এই সুপারিশ প্রণয়ন করেছে এমন একটি সময়কে সামনে রেখে, যেখানে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ অস্বীকার করা যায় না।
৪. কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা এবং হয়রানির বিরুদ্ধে শক্তিশালী আইনি কাঠামো
বর্তমানে নারী শ্রমিক, পেশাজীবী নারী কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত ছাত্রীদের এক বড় অংশ নিয়মিতভাবে হয়রানির শিকার হন। কমিশন চায়, হয়রানির সংজ্ঞা আরও বিস্তৃত হোক, অভিযোগ প্রক্রিয়া হোক দ্রুত ও নিরাপদ এবং সর্বোপরি, আইনি সহায়তা হোক ব্যয়মুক্ত ও সহজপ্রাপ্ত।
এই সংস্কার প্রস্তাবনা আসলে কতটা প্রয়োজনীয় ছিল?
প্রয়োজনীয়তা শুধু আজকের জন্য নয়, এটি বহুদিনের দাবি। দীর্ঘদিন ধরে আইনের নামেই লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্যকে “নিয়ম” হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ—একজন নারী স্বামী কর্তৃক নির্যাতনের পরও বিবাহবিচ্ছেদের জন্য প্রমাণাদি সংগ্রহ করতে বাধ্য হন, যেখানে পুরুষের ক্ষেত্রে সেই চাপ অনেকাংশে কম।
এছাড়া অভিভাবকত্বের লড়াইয়ে একজন মা প্রতিনিয়ত প্রমাণ করতে হয় যে তিনি “উপযুক্ত” অভিভাবক, যেখানে পিতার জন্য সেই প্রশ্নটাই অনুপস্থিত।
এই প্রতিবেদন আইন প্রণেতাদের জন্য একটি আইনা তুলে ধরেছে—যেখানে তাঁরা দেখতে পারেন, কতটা নীরবে আইনের হাত ধরে চলেছে বৈষম্যের কুহেলিকা।
রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া কেমন হতে পারে?
এই সংস্কার প্রস্তাবনা নিয়ে ইতোমধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে। অনেক উদারপন্থী ও মানবাধিকার সংগঠন এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে, ধর্মীয় গোষ্ঠী ও রক্ষণশীল আইনবিদদের একটি বড় অংশ এতে আপত্তি জানাতে পারেন, বিশেষ করে উত্তরাধিকার ও বিবাহ সংক্রান্ত সংস্কারের বিষয়ে।
তবে কমিশন মনে করে, সময় এসেছে আইনকেও বাস্তবতার সাথে মানিয়ে চলার। সমাজের রীতি বদলালে আইন বদলাতে হবে—এই নীতিতে ভর করে কমিশন এক ঐতিহাসিক প্রস্তাবের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে।
বাংলাদেশের আইনি কাঠামোর এমন সংস্কার প্রক্রিয়া কেবল নতুন আইন নয়, এটি একটি নতুন দর্শনের সূচনা। যেখানে নারী কেবল একজন “উপকারপ্রাপ্ত” নয়, বরং একজন পুরোপুরি নাগরিক—যার অধিকার আছে, সম্মান আছে এবং নিজের শরীর ও জীবনের উপর কর্তৃত্ব আছে।
The Bengal Lens এই সুপারিশমালার পরবর্তী রাজনৈতিক ও আইনগত প্রতিক্রিয়ার উপর নিবিড়ভাবে নজর রাখবে এবং ভবিষ্যতে সংশ্লিষ্ট পর্যালোচনাগুলো পাঠকের সামনে তুলে ধরবে।







https://cabinet.gov.bd/site/files/9e1348c9-e2c7-40c4-8f25-0effb1478c2d/%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%80-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B7%E0%A7%9F%E0%A6%95-%E0%A6%B8%E0%A6%82%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A6%AE%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A6%A6%E0%A6%A8