The Bengal Lens প্রতিবেদক ডেস্ক
জুলাই অভ্যুত্থানের দশ মাস পেরিয়ে যাওয়ার পর, কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা আবু বাকের মজুমদারের একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক অঙ্গন, সামাজিক মাধ্যম এবং নাগরিক পরিসরে শুরু হয়েছে ব্যাপক বিতর্ক, উত্তেজনা এবং মতবিভাজন। “হাসিনাকে সরায়ে গোলাম আজমের জন্য আমরা জুলাইয়ে রক্ত দেই নাই”—এই বাক্যে শুধু প্রতিবাদ নয়, জাতীয় রাজনীতির এক গভীর অসঙ্গতি ও বিভ্রান্তির ইঙ্গিত খুঁজে পাচ্ছেন বিশ্লেষকরা।
আবু বাকের মজুমদার কে?
আবু বাকের মজুমদার জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক ছিলেন। অভ্যুত্থান চলাকালে ডিবি (ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ) কর্তৃক নিখোঁজ হয়ে যাওয়া যেসব ছাত্রনেতার নাম উঠে এসেছিল, তাদের মধ্যে তিনিও ছিলেন।
বর্তমানে তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ভিত্তিতে গঠিত নতুন ছাত্র সংগঠন “বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ”-এর কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক হিসেবে কাজ করছেন। তার রাজনৈতিক বক্তব্য স্পষ্টভাবে ধর্মীয় মৌলবাদ, সাম্রাজ্যবাদ এবং স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। কিন্তু সম্প্রতি তার পোস্টগুলো আরও বেশি প্রকাশ্য, তীব্র এবং সরাসরি হয়ে উঠেছে।
গোলাম আজম ও নতুন বিতর্ক
সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামি ও তাদের ছাত্রসংগঠন শিবির যুদ্ধাপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত গোলাম আজমকে নতুনভাবে রাজনৈতিক মঞ্চে সামনে আনতে শুরু করেছে। কিছু অনুষ্ঠানে গোলাম আজমকে ‘মুসলিম বিশ্বের আলোকবর্তিকা’ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যমে গোলাম আজমের ছবিসহ প্রচারণা এবং কিছু ছাত্রগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে তাকে নিয়ে গান, স্লোগান ও meme ছড়ানো, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী নতুন প্রজন্মকে ক্ষুব্ধ করেছে।
এই প্রেক্ষাপটেই আবু বাকের মজুমদারের বিস্ফোরক পোস্ট:
“হাসিনা না হয় গড়পড়তা রাজাকার বলায় আমরা স্যাটায়ার করেছি, কিন্তু যে সত্যিকারের রাজাকার তাকে কি রাজাকার বলা যাবে না? গোলাম আজম কি রাজাকার না?”
এই প্রশ্নের মাধ্যমে তিনি মূলত সরাসরি জামায়াতপন্থী রাজনীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন।
শাহবাগে জাতীয় সংগীতে বাঁধা এবং উত্তাল জনমত
সম্প্রতি ঢাকার শাহবাগ এলাকায় আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ পরবর্তী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবেশনের সময় জামায়াত-শিবিরপন্থী একটি গোষ্ঠী বাধা সৃষ্টি করে। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও এবং ছবিতে দেখা যায়, ‘বাংলাদেশ নয়, ইসলামিক স্টেট চাই’ ধাঁচের স্লোগান দেওয়া হয়েছে। এমনকি কয়েকটি পোস্টে হুমকির ভাষায় লেখা হয়েছে—“জাতীয় সংগীত বাজালে রক্ত ঝরবে।”
আবু বাকের তার প্রতিক্রিয়ায় লেখেন:
“যারা বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশনা করলে প্রতিহত করার হুমকি দিয়েছেন তারা আইসেন। শুধু এইটুকু মাথায় রাইখা আগায়েন, আমরা একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধাদের উত্তরসূরী।”
জুলাই অভ্যুত্থান: রাজাকারদের বিরুদ্ধে না পক্ষে?
আলোচিত অভ্যুত্থানটি শুরু হয়েছিল বৈষম্য, দমন-পীড়ন ও গণতন্ত্রহীনতার বিরুদ্ধে। তবে ওই সময় কিছু অংশে রাজাকারপন্থী ও জামায়াতঘেঁষা গোষ্ঠী আন্দোলনের সুযোগ নেয়। তখন জেনারেশন জেডের বহু তরুণ সামাজিক মাধ্যমে “রাজাকার হইছে এখনকার ফ্যাশন”—জাতীয় স্যাটায়ার করে পোস্ট করে।আমরা সবাই রাজাকার , এমনকি অসংখ্য মিম আছে যেখানে জুলাই অভ্যুত্থান চলাকালীন হিন্দুরা হচ্ছে শিবিরের হিন্দু শাখা । এবং ওই সবগুলো ছিল একটি পক্ষের জন্য ছিল স্যাটায়ার
ওই সময়ের একটি স্লোগান ছিল “আমি কে ?তুমি কে ? রাজাকার রাজাকার ” ওই সময় মিডিয়াতে প্রচার করা হয়েছিল তারা জিনিসটি বলেনি তারা বরং এটিকে বলেছিল প্রতিবাদস্বরূপ । ওই সময়কার তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি সংবাদ সম্মেলনে কোটা এর একটি প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন “কোটা কি মুক্তিযোদ্ধা নাতিদের না নিয়ে রাজাকারের নাতিদের দিব ?”
তবে এখন এই পোস্টগুলো নতুন করে খতিয়ে দেখা হচ্ছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, সেই সময় কারা নেপথ্যে থেকে আন্দোলনের মুখ ব্যবহার করে রাজাকারপন্থী মতবাদকে উস্কে দিয়েছিল?কারণ বর্তমানে অনেকে আছে যারা নিজেদেরকে সত্যিকার অর্থে রাজাকারের সমর্থক হিসেবে পরিচয় দিচ্ছে । তারা গর্বিতভাবে 1971 এর বিরোধী । এমনকি মুখ্য সমন্বয়কদের একজন সাদিক কাইয়ুম পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের সভাপতি রুপে আত্মপ্রকাশ করে । ওই সংগঠনটি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের দোসর ছিল ।
সাম্প্রতিক ফেসবুক পোস্টগুলো ঘিরে আলোড়ন:
১. “তোরা যারা রাজাকার, সময় থাকতে বাংলা ছাড়!” ২. “গোলাম আজম তুই রাজাকার, বাংলা কি তোর বাপ দাদার?” ৩. “কারা শাহবাগে জাতীয় সংগীতে বাঁধা দিলো? কারা আমাদের বোনদের ধর্ষণের হুমকি দিচ্ছে?”
এসব পোস্টের মাধ্যমে আবু বাকের একটি সরাসরি রাজনীতির ভাষা ব্যবহার করছেন। তিনি শুধু মত প্রকাশ করছেন না, বরং আন্দোলনের মৌলিক দর্শন ও লক্ষ্যের রূপরেখা দাঁড় করাচ্ছেন।
বর্তমান পরিস্থিতির বিশ্লেষণ:
১. আদর্শগত সংঘাত: মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বনাম ধর্মীয় মৌলবাদ—এই দ্বন্দ্ব এখন আর গোপন নয়। এটি সরাসরি রাজনীতির কেন্দ্রে চলে এসেছে।
২. পুনরুজ্জীবিত জামায়াত: জামায়াতে ইসলামি ও ছাত্র শিবির নতুন করে সংগঠিত হচ্ছে, এবং তারা সামাজিক মাধ্যমে প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে।
- জুলাই অভ্যুত্থান ও বৈচিত্র্য: জুলাই আন্দোলন একক কোন দলীয় প্ল্যাটফর্ম ছিল না। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি যেমন ছিল, তেমনি কিছু বিতর্কিত গোষ্ঠীও সুযোগ নেয়। এখন সেসব সম্পর্ক ও অবস্থান নতুন করে মূল্যায়ন হচ্ছে।এমনকি সেখানে কিছু জীবিত মুক্তিযোদ্ধা পর্যন্ত অংশগ্রহণ করে । কারণ রাজাকার ট্যাগিং টি তখন দমন পীড়নের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছিল ।
- জাতীয় সংগীত নিয়ে বিদ্বেষ: জাতীয় সংগীতের বিরোধিতা কোনো মতবাদের মধ্যে পড়ে না। এটি সরাসরি বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে অবস্থান। যারা এতে বাধা দিচ্ছেন, তারা কার্যত স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরোধী বলেই বিবেচিত হচ্ছেন।
আবু বাকের মজুমদারের পোস্টগুলো যদি হয় রাজনৈতিক স্বতঃস্ফূর্ততা, তবে তা একাধারে প্রগতিশীল আন্দোলনের মুখপাত্র, আবার অন্যদিকে বিভাজনের সূচনাও হতে পারে। তবে এটুকু স্পষ্ট, তিনি যে রাজনীতির প্রতিনিধিত্ব করছেন তা স্বেচ্ছাচার, মৌলবাদ ও ইতিহাস বিকৃতির বিরুদ্ধে একটি সোচ্চার অবস্থান।
গোলাম আজমকে সামনে এনে নতুন প্রজন্মের রক্তে রঞ্জিত আন্দোলনকে ধোঁয়াশার মধ্যে ঠেলে দেওয়া কতটা বাস্তবসম্মত—তা সময় বলবে। তবে প্রশ্ন রয়ে যায়, জুলাইয়ে যারা রক্ত দিলেন, তারা কী চেয়েছিলেন? আর আজ সেই রক্তের উত্তরাধিকার কারা নিচ্ছেন?
এই প্রতিবেদনটি The Bengal Lens সামাজিক মাধ্যম ও প্রকাশ্য বক্তব্য বিশ্লেষণ করে তৈরি করেছে। এতে ব্যবহৃত তথ্য, মতামত ও উদ্ধৃতি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও উৎস থেকে নেওয়া হয়েছে।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর এই বিতর্ক সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। আবু বাকের মজুমদারের বক্তব্যে জাতীয় রাজনীতির গভীর অসঙ্গতি ফুটে উঠেছে। গোলাম আজমকে নিয়ে এই আলোচনা নতুন প্রজন্মকে ক্ষুব্ধ করছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে প্রশ্ন তোলা কতটা যুক্তিযুক্ত? জামায়াত-শিবিরের এই ধরনের কর্মকাণ্ড কি বাংলাদেশের ঐক্যকে ক্ষুণ্ন করছে না? জাতীয় সংগীতের প্রতি এই হুমকি কি আমাদের সংস্কৃতি ও স্বাধীনতার প্রতি অবমাননা নয়? এই পরিস্থিতিতে আমাদের কী করা উচিত?
এই লেখাটি পড়ে মনে হচ্ছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি খুবই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। আবু বাকের মজুমদারের বক্তব্য স্পষ্ট এবং সাহসী, যা বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতাকে চ্যালেঞ্জ করছে। গোলাম আজমকে নিয়ে এই আলোচনা এবং জামায়াত-শিবিরের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে, এই ধরনের বিতর্ক কি আসলেই সমাজে বিভেদ বাড়াচ্ছে নাকি সত্যিকারের আলোচনার পথ খুলে দিচ্ছে? সামাজিক মাধ্যমের ভূমিকা এখানে খুবই স্পষ্ট, কিন্তু এটা কি শুধুই উত্তেজনা বাড়াচ্ছে নাকি সচেতনতা তৈরি করছে? মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে নতুন প্রজন্মের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে, তারা সত্যিই ক্ষুব্ধ এবং সচেতন। কিন্তু এই ধরনের বিতর্ক কি আসলেই আমাদের একত্রিত করতে পারবে নাকি আরও বিভক্ত করবে? গোলাম আজমকে নিয়ে এই আলোচনা কি আসলেই প্রয়োজনীয়, নাকি এটা শুধুই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত?