মুজিবনগর, মেহেরপুর | ২৮ মার্চ ২০২৫
পেঁয়াজের দরপতনে চরম লোকসানের মুখে পড়ে বিষপান করেছিলেন মেহেরপুরের মুজিবনগরের কৃষক সাইফুল শেখ (৫৫)। বুধবার (২৬ মার্চ) নিজের চাষের জমিতে বিষপানের পর গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হলেও, বৃহস্পতিবার (২৭ মার্চ) কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। পরিবারের সদস্যরা জানান, উৎপাদন খরচ তুলতে না পারার মানসিক চাপে জর্জরিত সাইফুল শেষ পর্যন্ত আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেন। স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে এমন এক কৃষকের মৃত্যু বাঙালি জাতির জন্য লজ্জাজনক ও হৃদয়বিদারক। এ ঘটনা কেবল একটি পরিবারের দুঃখের গল্প নয়, বরং আমাদের কৃষি সমাজ ও অর্থনীতির একটি গভীর সংকটের প্রতিচ্ছবি।
সাইফুলের জীবন ও সংগ্রাম
মুজিবনগরের ভবেরপাড়া এলাকার বাসিন্দা সাইফুল শেখ ছিলেন একজন পরিশ্রমী কৃষক। তার বাবা দুলাল শেখও জীবনের বেশিরভাগ সময় কৃষিকাজের মাধ্যমে পরিবারের ভরণপোষণ করেছিলেন। পৈতৃক পেশার ধারাবাহিকতায় সাইফুলও জমিতে ফসল ফলিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন। প্রতিদিন সূর্যোদয়ের আগে তিনি জমিতে যেতেন, কঠোর পরিশ্রম করে ফসলের পরিচর্যা করতেন এবং স্বপ্ন দেখতেন তার পরিবারের জন্য একটি স্বচ্ছল জীবনের। পেঁয়াজ, আলু, ধান—এই ফসলগুলোই ছিল তার জীবনের ভিত্তি। কিন্তু এবার পেঁয়াজের বাজারে অস্বাভাবিক দরপতন তার সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার করে দেয়।
পরিবারের সদস্যরা জানান, এবারের মৌসুমে পেঁয়াজের দাম এতটাই কমে গিয়েছিল যে উৎপাদন খরচের একটি ভগ্নাংশও তুলে আনা সম্ভব হয়নি। বীজ, সার, কীটনাশক, শ্রম—এসবের জন্য সাইফুলকে ঋণ করতে হয়েছিল। কিন্তু ফসল বাজারে নিয়ে গেলে তিনি যে দাম পেয়েছেন, তা দিয়ে ঋণের সুদও পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। এই অসহায় অবস্থা তাকে মানসিকভাবে ভেঙে দেয়। তার মেয়ে রফিজা খাতুন কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “বাবা প্রায়ই বলতেন, ‘এভাবে আর বাঁচা যায় না। আমি কীভাবে তোদের মুখের দিকে তাকাবো?’ আমরা তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি, কিন্তু তিনি হয়তো আর কোনো পথ দেখতে পাননি।”
স্বাধীনতা দিবসে জমিতে বিষপানের ঘটনা
বুধবার (২৬ মার্চ) সকাল ১১টার দিকে সাইফুল তার চাষের জমিতে যান। এটি ছিল তার নিয়মিত রুটিনের একটি অংশ। কিন্তু সেদিন তিনি ফসলের পরিচর্যা করতে যাননি। পরিবারের লোকজন জানান, জমিতে পৌঁছে তিনি একা দাঁড়িয়ে ছিলেন। তারপর একটি বোতল থেকে বিষপান করেন। কিছুক্ষণ পর স্থানীয় কৃষকরা তাকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে পরিবারকে খবর দেন। পরিবারের সদস্যরা দ্রুত তাকে মেহেরপুর সদর হাসপাতালে নিয়ে যান। প্রাথমিক চিকিৎসার পর তার অবস্থা আরও খারাপ হলে চিকিৎসকরা তাকে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে স্থানান্তর করেন। সেখানে চিকিৎসকরা তাকে বাঁচানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করলেও, বৃহস্পতিবার তিনি মৃত্যুর কাছে হার মানেন।
মুজিবনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমান জানান, “আমরা নিশ্চিত হয়েছি যে সাইফুল শেখ বিষপান করেছিলেন। পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ না থাকায় আমরা বিনা ময়নাতদন্তে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেছি। তবে ঘটনার পেছনের কারণগুলো জানতে আমরা তদন্ত শুরু করেছি।” তিনি আরও বলেন, “এটি একটি দুঃখজনক ঘটনা। আমরা দেখছি এর পেছনে আর কোনো বিষয় জড়িত আছে কি না।”
কৃষকের জীবনের সংকট
সাইফুল শেখের মৃত্যু আমাদের সমাজে কৃষকদের জীবনযাত্রার একটি কঠিন বাস্তবতা তুলে ধরে। বাংলাদেশের মতো কৃষিপ্রধান দেশে কৃষকরাই আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার মূল ভিত্তি। তারা সারা বছর কঠোর পরিশ্রম করে ফসল ফলান, কিন্তু বাজার ব্যবস্থার অস্থিরতা তাদের জীবনকে বিপন্ন করে তোলে। পেঁয়াজের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় ফসলের দাম যখন উৎপাদন খরচের চেয়েও কমে যায়, তখন কৃষকরা চরম দারিদ্র্য ও হতাশার মুখে পড়েন। সাইফুলের ঘটনা এমন একটি চিত্র তুলে ধরে, যেখানে একজন কৃষক তার পরিশ্রমের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে জীবন পর্যন্ত ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
এই ঘটনা কেবল সাইফুলের পরিবারের জন্য নয়, আমাদের সমগ্র সমাজের জন্য একটি জ্বলন্ত প্রশ্ন রেখে যায়। কৃষকদের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করার দায়িত্ব কার? বাজারে দরপতনের কারণে যখন কৃষকরা লোকসানের মুখে পড়েন, তখন সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কী ব্যবস্থা নিচ্ছে? কৃষকদের জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্য নির্ধারণ, ঋণের সহজ শর্ত, এবং বাজার নিয়ন্ত্রণের কার্যকর পদক্ষেপ কি আমাদের দেশে পর্যাপ্তভাবে গ্রহণ করা হচ্ছে? সাইফুলের মতো কৃষকদের জীবন বাঁচাতে আমরা কী করছি?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পেঁয়াজের দরপতনের পেছনে অনেকগুলো কারণ কাজ করে। মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য, আমদানি নীতির অস্পষ্টতা, এবং বাজারে চাহিদা-যোগানের ভারসাম্যহীনতা এর মধ্যে অন্যতম। কিন্তু এই সমস্যার সমাধান না করে আমরা যদি কৃষকদের ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিই, তাহলে এমন ঘটনা বারবার ঘটবে। সাইফুলের মৃত্যু আমাদের জন্য একটি সতর্কবার্তা।
স্বাধীনতা দিবসে এ আত্মহত্যা লজ্জার
স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে এমন একটি ঘটনা আমাদের জাতির জন্য গভীর লজ্জার। যে দেশের কৃষকরা আমাদের অন্ন জোগান, তাদের যদি আমরা জীবনের নিশ্চয়তা দিতে না পারি, তাহলে আমাদের স্বাধীনতার মূল্য কী? সাইফুল শেখের মৃত্যু কেবল একটি পরিসংখ্যান নয়, এটি আমাদের সমাজের প্রতি একটি অভিযোগ। তিনি তার জমিতে ফসল ফলিয়েছিলেন, কিন্তু ফসলের দাম না পেয়ে জীবন দিয়ে তার মূল্য চুকিয়েছেন।
এই ঘটনা আমাদের সবাইকে ভাবতে বাধ্য করে—আমরা কি সত্যিই কৃষকদের পাশে আছি?সাইফুল শেখের মৃত্যু আমাদের সমাজের জন্য একটি আয়না। এটি আমাদের দেখায় যে, আমাদের কৃষি ব্যবস্থায় এখনও অনেক ত্রুটি রয়ে গেছে। কৃষকদের জীবন বাঁচাতে হলে কেবল সহানুভূতি প্রকাশ করলেই চলবে না, প্রয়োজন কার্যকর পদক্ষেপ। ন্যায্য মূল্য, সঠিক বাজার ব্যবস্থাপনা, এবং কৃষকদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের সময়ের দাবি। সাইফুলের মৃত্যু যেন শেষ ঘটনা না হয়। তার পরিবারের কান্না যেন আমাদের সবাইকে জাগিয়ে তোলে। কৃষকদের জীবনের মূল্য দিতে হবে—এটাই আমাদের প্রতিশ্রুতি হোক।
jan9z1