নিউজ ডেস্ক: দ্য বেঙ্গল লেন্স
বাংলা ভাষাভাষী ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা এখন প্রায় সাত কোটি, যাদের প্রতিদিনের ডিজিটাল জীবন অসংখ্য তথ্যের স্রোতে আবর্তিত। কিন্তু এই স্রোতের একটি বিশাল অংশই মিথ্যা, বিকৃত বা অর্ধসত্য তথ্যের বন্যায় ভরা। তথ্যযুদ্ধে দিশেহারা এই বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য একটি নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে দেশের প্রথম ও পূর্ণাঙ্গ এআই-চালিত ফ্যাক্টচেকিং প্ল্যাটফর্ম ‘খোঁজ‘ (www.khoj-bd.com)।
গুজবের গতি: এক মাসে ২৯৮টি ভুয়ো তথ্য!
ডিজিটাল দুনিয়ায় গুজব ছড়ানোর গতি কতটা ভয়াবহ, তার প্রমাণ পাওয়া যায় সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে। শুধু গত ২০২৫ সালের মার্চ মাসেই, বাংলাদেশের স্বনামধন্য ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান রিউমার স্ক্যানার শনাক্ত করেছে ২৯৮টি ভুয়া তথ্য। চলতি বছরের শুরুতে ক্যানসার চিকিৎসা, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ বা অন্যান্য বিষয়ে ওষুধের ভুয়া প্রচারে সংবাদমাধ্যমের লোগো ব্যবহার কিংবা এআই-এর মাধ্যমে তারকাদের ভুয়া সাক্ষাৎকার বানিয়ে বহু ইন্টারনেট ব্যবহারকারী প্রতারণার শিকার হয়েছেন।
এই পরিস্থিতিতে, বাংলা ভাষায় হাতে গোনা কয়েকটি ফ্যাক্টচেকিং প্ল্যাটফর্মের সীমিত কার্যক্রম ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ সেখানে ব্যবহারকারী নিজে নতুন কোনো দাবি যাচাই করতে পারতেন না।
‘খোঁজ’-এর জন্ম: ফ্যাক্টচেকার এবার আপনি নিজেই
এই সীমাবদ্ধতা ভাঙতেই জন্ম নিয়েছে ‘খোঁজ’—যা বাংলা ভাষার প্রথম এবং সবচেয়ে পূর্ণাঙ্গ এআই-চালিত ফ্যাক্টচেকিং প্ল্যাটফর্ম। এর সবচেয়ে বড় বিশেষত্ব হলো: “এখানে ফ্যাক্টচেকার কোনো প্রতিষ্ঠান নয়, ফ্যাক্টচেকার আপনি নিজেই।”
প্ল্যাটফর্মটির প্রতিষ্ঠাতা মাহাথির আহমেদ তুষার বলেন, “টেক্সট, ছবি, ঐতিহাসিক ঘটনা কিংবা ভাইরাল হয়ে ছড়িয়ে পড়া গুজব, সবকিছুর সত্যতা যাচাই করতে খোঁজ হয়ে উঠতে পারে নির্ভরযোগ্য সঙ্গী।”
উদ্ভাবক দল
‘খোঁজ’-এর নেপথ্যে রয়েছেন একটি তরুণ দল:
- মাহাথির আহমেদ তুষার: এই প্ল্যাটফর্মটির এআই আর্কিটেকচার ডিজাইন করেছেন।
- সাগর চন্দ্র দে: বাংলা ইন্টারফেস তৈরি করেছেন।
- তানিয়া আক্তার চৈতি: প্ল্যাটফর্মটির তথ্যভান্ডার তৈরি ও ফ্যাক্টচেকিংয়ের মানোন্নয়নে কাজ করেছেন।
- আবু কাউসার: ‘খোঁজ’ ধারণার উদ্ভাবন করেন।
মাত্র ৩০ সেকেন্ডে সত্য উন্মোচন
ব্যবহারকারী যখনই কোনো বিভ্রান্তিকর খবর, যেমন “বাংলাদেশের নিঝুম দ্বীপ চীনের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে,” বা অন্য কোনো ভাইরাল দাবি যাচাই করতে চান, ‘খোঁজ’ তা মাত্র ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই বিশ্লেষণ করে।
তুষার জানান, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রথমে খবরটিকে ঘিরে ওয়েব, সোশ্যাল পোস্ট, নিউজ আর্কাইভ এবং মাল্টিমিডিয়া ঘেঁটে মূল উৎস খুঁজে বের করে। এরপর সূত্রের নির্ভরযোগ্যতা যাচাই করা হয়, প্রাসঙ্গিকতা পরীক্ষা করে টেক্সট ও ছবি বিশ্লেষণ করা হয়। সবশেষে, একটি পূর্ণাঙ্গ ফ্যাক্টচেক রিপোর্ট তৈরি করে দেওয়া হয়। এই রিপোর্টে স্পষ্ট সিদ্ধান্ত থাকে—দাবিটি সত্য, বিভ্রান্তিকর না সম্পূর্ণ ভুল—এবং দেওয়া থাকে তথ্যের উৎস লিঙ্ক।
যেভাবে কাজ করে এআই
খোঁজের কার্যপ্রণালী একটি শক্তিশালী প্রযুক্তিগত কাঠামোর ওপর নির্ভরশীল:
- বিশ্বাসযোগ্য উৎসের তালিকা: প্ল্যাটফর্মটি বাংলা ও ইংরেজি ভাষার প্রায় দেড় শতাধিক স্বীকৃত সংবাদমাধ্যম, ফ্যাক্টচেকিং সংস্থা, বৈজ্ঞানিক জার্নাল ও বিশ্বস্ত স্বাস্থ্যবিষয়ক ওয়েবসাইটের একটি বাছাইকৃত তালিকা ব্যবহার করে।
- প্রশ্নের অপটিমাইজেশন (Query Parsing): ব্যবহারকারীর স্বাভাবিক ভাষার প্রশ্নকে এআই সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর অনুসন্ধান শব্দগুচ্ছে রূপান্তর করে অনুসন্ধানের নির্ভুলতা বাড়ায়।
- ওয়েব ক্রলিং ও ফিল্টারিং: ক্রলিং পাইপলাইন পূর্বনির্ধারিত উৎস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। প্রতিটি তথ্যকে সাম্প্রতিকতা (Recency Score), উৎসের বিশ্বাসযোগ্যতা (Authority Score) এবং কীওয়ার্ড প্রাসঙ্গিকতার (Keyword Match Score) ভিত্তিতে স্কোরিং করা হয়।
- ফলব্যাক অনুসন্ধান: যদি কিউরেটেড উৎসে কোনো তথ্য না পাওয়া যায়, তবে ট্যাভিলি এপিআই (Tavily API)-এর মতো বিশেষ টুল ব্যবহার করে পুরো ওয়েবের বিশ্বস্ত জায়গাগুলোতে অনুসন্ধান চালানো হয়।
বিশেষায়িত ফিচার: শুধু ফ্যাক্টচেক নয়
‘খোঁজ’ কেবল একটি ফ্যাক্টচেকিং টুল নয়, এর রয়েছে বেশ কিছু বিশেষ ফিচার যা তথ্য যাচাইকে আরও গভীর ও বিস্তৃত করে:
- এআই মিথবাস্টিং: যেকোনো কুসংস্কার বা বৈজ্ঞানিক দাবির ক্ষেত্রে এআই শুধু সিদ্ধান্তই দেয় না, বরং বৈজ্ঞানিক প্রমাণ ও প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে ব্যবহারকারীর সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনার দক্ষতা বাড়ায়।
- রিভার্স মিডিয়া সার্চ: ব্যবহারকারী ছবি আপলোড করে জানতে পারেন ছবিটি ইন্টারনেটে আর কোথায় আছে, যার ফলে কোনো ছবির পেছনের মূল প্রেক্ষাপট বা গুজব সহজেই ধরা পড়ে।
- লেখা যাচাই: বাংলা লেখার ডুপ্লিকেট কনটেন্ট, প্লেজিয়ারিজম এবং সেটি মানুষের লেখা নাকি এআই-এর তৈরি, তা নির্ভুলভাবে নির্ধারণ করা যায়।
- খোঁজ চ্যাট: এই চ্যাট ফিচারে তিনটি বিশেষ মোড রয়েছে— ‘জেনারেল মোড‘, সরাসরি ফ্যাক্টচেকের জন্য ‘যাচাই‘ মোড এবং সরকারি সেবাসহ নাগরিক সম্পর্কিত তথ্যের জন্য ‘নাগরিক সেবা‘ মোড।
- মুক্তিযুদ্ধ কর্নার – লিবারেশন ওয়ার ইঞ্জিন: ঐতিহাসিক ঘটনা নিয়ে রটা গুজব রোধ করতে এটি মুক্তিযুদ্ধ দলিল, গবেষণামূলক গ্রন্থ ও ঐতিহাসিকদের লেখা বইপত্র থেকে সবচেয়ে পক্ষপাতহীন ও অথেন্টিক ফলাফল এনে দেয়।
চ্যালেঞ্জ ও উপসংহার
যদিও ‘খোঁজ’-এর মতো সমন্বিত ব্যবস্থা ডিজিটাল তথ্য পরিবেশে স্বচ্ছতা ও সচেতনতা বাড়াতে সহায়ক, তবে এর কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে। সোর্স বায়াস, রিয়েল-টাইম আপডেটে সামান্য বিলম্ব এবং এআই-ভিত্তিক সারাংশে সূক্ষ্ম ভুলের সম্ভাবনা থাকতে পারে। তাই ব্যবহারকারীদের সবসময় মূল সোর্স লিঙ্ক যাচাই করা গুরুত্বপূর্ণ।
মাহাথির আহমেদ তুষার আশা করেন, “যে কেউ এখন গুজব খন করতে পারবে ‘খোঁজ’-এর মাধ্যমে,” যা ডিজিটাল যুগে তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।
সত্যান্বেষের এই যাত্রায় যোগ দিতে পারেন খোঁজের সাথে: https://www.khoj-bd.com/