শিক্ষার্থীদের ধাওয়ায় আহত যুবলীগ নেতা পেলেন জুলাই যোদ্ধা অনুদান

শিক্ষার্থীদের ধাওয়ায় আহত যুবলীগ নেতা পেলেন জুলাই যোদ্ধা অনুদান

দ্য ব্যাঙ্গল লেন্স | ১৮ মে ২০২৫ | ঢাকা


একটি সিদ্ধান্ত, হাজার প্রশ্ন

গত বছরের জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশের রাজপথে যে ছাত্র-জনতার আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছিল, তা শুধু একটি সরকারের পতনই ঘটায়নি, বরং দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক কাঠামোর গভীরে একটি দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতের জন্ম দিয়েছে। সেই আন্দোলনের কেন্দ্রে ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, যারা কোটা সংস্কারের দাবিতে রাজপথে নেমেছিল। কিন্তু এই আন্দোলন শুধু দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি; এটি রক্তাক্ত সংঘর্ষ, রাষ্ট্রীয় দমনপীড়ন এবং অগণিত তরুণের আত্মত্যাগের গল্পে রূপ নিয়েছিল। এই আন্দোলনের ফলে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে, এবং ক্ষমতায় আসে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার।

কিন্তু এই অন্তর্বর্তী সরকারের একটি সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন ঝড় তুলেছে। সাতকানিয়া উপজেলার ছদাহা ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি মো. আজহার উদ্দীন, যিনি ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় শিক্ষার্থীদের ধাওয়ায় আহত হয়েছিলেন বলে দাবি করেন, তাকে সম্প্রতি ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আর্থিক অনুদান প্রদান করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের পর থেকে সামাজিক মাধ্যম থেকে রাজপথ—সর্বত্রই উঠছে প্রশ্ন: যিনি ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ মিছিলে সশস্ত্র হামলার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন, তিনি কীভাবে ‘জুলাই যোদ্ধা’ হন? এই সিদ্ধান্ত কি অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতার প্রতি প্রশ্ন তুলছে, নাকি এটি একটি প্রশাসনিক ভুলের ফল?

এই প্রতিবেদনে আমরা আজহার উদ্দীনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তের পেছনের প্রেক্ষাপট, এর রাজনৈতিক প্রভাব, এবং জনগণের প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করব। আমরা দেখব, কীভাবে একটি একক সিদ্ধান্ত দেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশার জন্ম দিচ্ছে, এবং কেন এটি অন্তর্বর্তী সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার প্রতি প্রশ্ন তুলছে।


আজহার উদ্দীন কে?

মো. আজহার উদ্দীন (৪৮), সাতকানিয়া উপজেলার ছদাহা ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মৌলানা ছগির শাহ পাড়ার বাসিন্দা। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ছদাহা ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। স্থানীয় রাজনীতিতে তার নাম বিতর্কের সঙ্গে জড়িত। ক্ষমতার দাপট, এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, এবং একের পর এক হামলার অভিযোগে তিনি স্থানীয়ভাবে কুখ্যাত। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের তালিকা দীর্ঘ—দলীয় প্রভাব খাটিয়ে অপকর্ম থেকে শুরু করে সশস্ত্র সহিংসতা পর্যন্ত।

২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় আজহার উদ্দীনের নাম আবারও আলোচনায় আসে। স্থানীয় সূত্র এবং পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, তিনি ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ মিছিলে সশস্ত্র হামলার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এই হামলার ঘটনায় শিক্ষার্থীদের পাল্টা ধাওয়ায় তিনি আহত হন। পরবর্তীতে, ২০২৫ সালের ১৩ মে রাত ১টার দিকে সাতকানিয়ার কেরানীহাট স্টেশনে পুলিশ অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করে। সাতকানিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) জানান, ছাত্র আন্দোলনের সময় হামলার মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

কিন্তু গ্রেপ্তারের মাত্র কয়েক মাস পরই আজহার উদ্দীনের নাম আবারও সংবাদের শিরোনামে। এবার তিনি ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে তাকে আর্থিক অনুদান দেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের পর থেকে সাতকানিয়া থেকে ঢাকা—সর্বত্রই শুরু হয়েছে তীব্র বিতর্ক।


‘জুলাই যোদ্ধা’ কারা?

‘জুলাই যোদ্ধা’ শব্দটি ২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পর থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক আলোচনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছে। এই আন্দোলনের সময় যারা রাজপথে নেমেছিলেন, রাষ্ট্রীয় দমনপীড়নের মুখে আঘাত পেয়েছিলেন, এমনকি প্রাণ হারিয়েছিলেন, তাদেরকে ‘জুলাই শহীদ’ ও ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে সম্মান জানানোর উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এই উদ্যোগের অংশ হিসেবে আহতদের জন্য আর্থিক অনুদান এবং শহীদদের পরিবারের জন্য সহায়তার ঘোষণা দেওয়া হয়।

কিন্তু ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে কারা যোগ্য, তা নিয়ে স্পষ্ট কোনো নির্দেশিকা প্রকাশ করেনি সরকার। ফলে, যাচাই-বাছাইয়ের প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। আজহার উদ্দীনের মতো ব্যক্তি, যিনি আন্দোলনের সময় ছাত্রদের ওপর হামলার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন, তিনি কীভাবে এই তালিকায় স্থান পেলেন? এই প্রশ্ন এখন সবার মুখে মুখে।

স্থানীয় একজন ছাত্রনেতা, যিনি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, বলেন, “আমরা রাজপথে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে আন্দোলন করেছি। আমাদের অনেক বন্ধু গুলিবিদ্ধ হয়েছে, অনেকে প্রাণ হারিয়েছে। আর যারা আমাদের ওপর হামলা করেছে, তারা এখন ‘যোদ্ধা’ হিসেবে টাকা পাচ্ছে? এটা কোন ধরনের ন্যায়বিচার?”


তৃতীয় অধ্যায়: অন্তর্বর্তী সরকারের ভূমিকা

অন্তর্বর্তী সরকার, যার নেতৃত্বে রয়েছেন নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস, ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই একটি কঠিন পথে হাঁটছে। একদিকে তাদের দায়িত্ব দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা, অন্যদিকে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করা। কিন্তু মাত্র ১০ মাসের শাসনকালে সরকারের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে উঠেছে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাবের অভিযোগ।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বলেছেন, “অন্তর্বর্তী সরকারের চিন্তা এবং কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কে জনগণ অন্ধকারে থাকায় দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে অস্থিরতা বাড়ছে।” তিনি আরও বলেন, “আমরা প্রায়ই দেখছি, বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ রাজপথে জড়ো হচ্ছেন।” আজহার উদ্দীনের ঘটনা এই অস্থিরতাকে আরও উসকে দিয়েছে।

একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক, যিনি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকারের এই ধরনের সিদ্ধান্ত তাদের নিরপেক্ষতার প্রতি প্রশ্ন তুলছে। যদি তারা সত্যিই গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষে থাকত, তাহলে আজহারের মতো ব্যক্তি কখনোই এই তালিকায় স্থান পেত না। এটি হয়তো স্থানীয় প্রশাসনের ত্রুটি, কিন্তু দায় এড়াতে পারে না কেন্দ্রীয় সরকার।”


জনগণের প্রতিক্রিয়া

আজহার উদ্দীনকে ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্তের পর থেকে সামাজিক মাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। ফেসবুক, এক্স, এবং অন্যান্য প্ল্যাটফর্মে হাজার হাজার মানুষ তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। একজন শিক্ষার্থী ফেসবুক-এ লিখেছেন, “যারা আমাদের ওপর হামলা করেছে, তারা এখন যোদ্ধা? এটা কি সেই স্বাধীনতার জন্য আমরা রক্ত দিয়েছিলাম?”

সাতকানিয়ার স্থানীয় বাসিন্দারাও এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছেন। গত ১৫ মে একটি বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নেওয়া একজন শিক্ষার্থী বলেন, “আজহার উদ্দীন আমাদের গ্রামের মানুষের ওপর বছরের পর বছর অত্যাচার করেছে। তাকে যোদ্ধা বলা আমাদের আন্দোলনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা।”


কী করা উচিত?

আজহার উদ্দীনের ঘটনা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। এই ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে সরকারকে আরও সতর্ক এবং স্বচ্ছ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করা জরুরি:

১. যাচাই-বাছাইয়ের স্বচ্ছ প্রক্রিয়া: ‘জুলাই যোদ্ধা’ হিসেবে কাদের স্বীকৃতি দেওয়া হবে, তার জন্য একটি স্পষ্ট নির্দেশিকা প্রণয়ন করতে হবে। এই প্রক্রিয়ায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, ছাত্রনেতা এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা উচিত।

২. জনগণের অংশগ্রহণ: সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়ায় জনগণের মতামত গ্রহণের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা উচিত। এটি সরকারের স্বচ্ছতা বাড়াবে।

৩. ভুল সংশোধন: আজহার উদ্দীনের ক্ষেত্রে যদি কোনো ভুল হয়ে থাকে, তবে সরকারকে অবিলম্বে তা সংশোধন করে জনগণের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। এটি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করবে।

৪. নিরপেক্ষ তদন্ত: এই ঘটনার পেছনে কোনো রাজনৈতিক চাপ বা প্রশাসনিক ত্রুটি ছিল কিনা, তা তদন্ত করতে হবে। তদন্তের ফলাফল জনগণের সামনে প্রকাশ করতে হবে।


Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *